কে ছিলেন একলব্য? তাঁকে কে বধ করেছিলেন? Who Was Ekalavya?

কে ছিলেন একলব্য? তাঁকে কে বধ করেছিলেন? Who Was Ekalavya?

বলা হয় “মহত্ত্বাদ্ ভারতবত্ত্বাচ্চ মহাভারতমুচ্যতে।” অর্থাৎ, যা নেই ভারতে তা নেই মহাভারতে। সত্যিই তো, ধর্ম-অধর্ম, ত্যাগ-স্বার্থপরতা, ঔদার্য্য-সংকীর্ণতা, দেবতা-অসুর, ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ এই সবকিছুরই যেন চরমতম সমন্বয় ঘটেছে মহাভারতে। আর এগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন মহাভারতের সেই রথী-মহারথী চরিত্ররা। হ্যাঁ, ধর্মের পথ অনুসরণকারী ও মহাভারতের যুদ্ধের বিজয়ী হিসেবে হয়ত পাণ্ডবরাই মানুষের মনের মণিকোঠায় বসবাস করেন সর্বক্ষন, তবে পাণ্ডবরা ছাড়াও গুরু দ্রোন, পিতামহ ভীষ্ম, দাতা কর্ণ প্রমুখরা পাণ্ডবদের বিরুদ্ধাচারণ করলেও ইতিহাস কিন্তু তাদেরকে যথাযথ মর্যাদার সাথেই স্থান দিয়েছে। ঠিক এমনই একটি মহাভারতের চরিত্র একলব্য। স্বার্থের হাড়িকাঠে বলি হওয়া এই দুর্ণিবার ধনুর্ধরের উপস্থিতি খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও তা মানুষের মনে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। আজ এই মহান যোদ্ধাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আজ আমরা জানব আসলে কে ছিলেন একলব্য। তিনি কি আসলে নিশাদরাজের পুত্র ছিলেন নাকি তার পিতা অন্য কেউ? তার আঙ্গুল কেটে ফেলার পর কি ঘটেছিল তার বাকী জীবনে? আর কেই বা তাকে বধ করেছিলেন।


খোদ মহাভারতেই একলব্যের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। যেটুকু পাওয়া যায় তা হল, তিনি ভিল আদিবাসীদের নিষাদ নামক একটি রাজ্যের রাজা হিরণ্যধনু ও রানী বিশাখার সন্তান। একলব্য চেয়েছিলেন নিজেকে বড় ধণুর্ধর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। তাই অস্ত্রশিক্ষা করতে অনেক আশা নিয়ে শরনাপন্ন হয়েছিলেন রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষক গুরু দ্রোনাচার্যের। কিন্তু গুরু দ্রোণাচার্য প্রত্যাখ্যান করলেন একলব্যের শিষ্যত্ব । দ্রোণাচার্যের এহেন বিমাতাসুলভ আচরনের কারন বিশ্লেষণ করলে চারটি বিষয় সামনে আসে, প্রথমত একলব্য ছিলেন শুদ্রজাত সন্তান, দ্বিতীয়ত রাজপরিবারের গুরুদের বহিরাগত কাউকে শিষ্য হিসেবে গ্রহন করার পরম্পরা ছিল না তৃতীয়ত, গুরু দ্রোণ পাঞ্চালরাজ ধ্রুপদকে পরাজিত করার জন্য  অপ্রতিদন্দ্বী হিসেবে প্রস্তুত করছিলেন অর্জুনকে, তাই একলব্যকে শিক্ষা দেওয়াটাও তার প্রতিশোধ নেওয়ার পথে বাধা হয়ে দাড়াতে পারে।  এবং চতুর্থত, একলব্য ছিলেন নিষাদরাজের পুত্র। নিষাদরা ছিলেন জরাসন্ধের মিত্রশক্তি। অন্যদিকে জরাসন্ধ ছিলেন যাদব ও কুরু বংশের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই যতই বাজপরিবারের অস্ত্রগুরু হন না কেন দ্রোণাচার্য এই এত বড় বড় বাধার দেওয়ালগুলো ডিঙাতে পারেন নি।


তবে হার মানেননি একলব্য। গুরু দ্রোণের প্রতিও বীতশ্রদ্ধ হন নি একটুও। বরং গহীন বনে দ্রোণাচার্যের মুর্তি গড়ে তার সামনেই শুরু করলেন অনুশীলন। দিনের পর দিন তার কঠোর অধ্যাবসায় আর অনুশীলনের ফলে একের পর এক রপ্ত করতে থাকেন অস্ত্রবিদ্যার কঠিন থেকে কঠিনতম কৌশলগুলো। এক পর্যায়ে তিনি হয়ে উঠলেন এক মহা পরাক্রমশালী এবং দুর্ণিবার ধনুর্বিদ। একদিন অস্ত্র শিক্ষা করার সময় রাজকুমারদের একটি কুকুর বারবার শব্দ করে তার অনুশীলনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। তাই তিনি তার মুখে এমনভাবে একটি বাণ নিক্ষেপ করেন যাতে তার প্রাণহানি না ঘটে আবার শব্দও না করতে পারে। কিন্তু এটিই কাল হয়ে দাড়ালো একলব্যের জীবনে। বাণবিদ্ধ কুকুরটি যখন ফিরে গেল তখন দ্রোণাচার্য শঙ্কিত হয়ে ঊঠলেন। কারন, কোন সাধারন ধনুর্ধর এভাবে বাণ নিক্ষেপ করতে পারেন না, বরং কোন দুর্দান্ত প্রতিভাশালী ধনুর্বিদের পক্ষেই এই কাজ করা সম্ভব। দুশ্চিন্তায় পড়লেন দ্রোণ। তবে কি তিনি অর্জুণকে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন না? তিনি কি অর্জুণকে দেওয়া কথা রাখতে পারবেন না? রাজা ধ্রুপদের বিরুদ্ধে তার প্রতিশোধ নেওয়া কি সম্ভব হবে না? প্রশ্নের পাহাড় মাথায় করে সেই ধনুর্বিদকে খুঁজতে বনের মধ্যে চললেন দ্রোণাচার্য। কিন্তু একি? এতো সেই একলব্য, যাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এত অল্প সময়ে সে কিভাবে এত দক্ষ তীরন্দাজে পরিনত হল? দ্রোণাচার্যের মাথায় যখন এরকম হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তখন হঠত একলব্য এসে দ্রোণাচার্যের পদস্পর্শ করে আশির্বাদ নিলেন। বিষ্ময়ের ঘোর কাটিয়ে দ্রোণাচার্য জিজ্ঞাসা করলেন, কুকুরটিকে কি তুমি বাণবিদ্ধ করেছ? উত্তর এল, “হ্যাঁ, গুরুদেব”। গুরু দ্রোন আবার প্রশ্ন করলেন, আমাকে গুরুদেব বলছ কেন? আমি কি আসলেই তোমার গুরু? একলব্য তখন দ্রোণাচার্যকে তার মুর্তিটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করালেন। বললেন, হ্যাঁ আপনিই আমার গুরুদেব, আপনার মুর্তিকে গুরুদেব মেনে আমি আমার অধ্যাবসায় ও অনুশীলন চালিয়ে গিয়েছি। বিষ্ময়ের ঘোর কাটিয়ে গুরু দ্রোণ এক নজিরবিহীন কাজটি করে বসলেন। তিনি বললেন, বতস একলব্য, তোমার অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে, এবার তোমার গুরুদক্ষিণা দেওয়ার পালা। আনন্দের আতিশয্যে বিহ্বল একলব্য যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার গুরুদেব আজ তাকে শিষ্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তাই সানন্দে তিনি গুরুকে গুরুদক্ষিণা দিতে প্রস্তুত হলেন। দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা হিসেবে চাইলেন তার বৃদ্ধাঙ্গুলি যা ছাড়া কোন তীরন্দাজের পক্ষেই বাণ চালানো সম্ভব নয়। অন্যদিকে দ্বিতীয়বার না ভেবে একলব্য নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি কর্তন করে গুরুকে সমর্পন করলেন তিনি। আর এভাবেই মহাভারতের এক গুরুত্বপুর্ণ চরিত্র ফুটে ওঠার আগেই ঝরে গেল সবার অগোচরে। এবং মহাভারত গ্রন্থেও একলব্যের উপস্থিতি ঠিক এ পর্যন্তই। কিন্তু তার সম্পর্কে আরও কিছু জানার বাকী থেকে যায় আমাদের। আমরা জানতে চাই আসলে কে ছিলেন এই ধনুর্বিদ? আঙ্গুল কাটার পর কি ঘটেছিল তার জীবনে এবং কিভাবে তিনি বীরগতি প্রাপ্ত হন। আর এগুলো জানার জন্য আমাদেরকে যেতে হবে পুরাণে।


হরিবংশ পুরাণ মতে যাদব শ্রেষ্ঠ বসুদেবের ‘দেবশ্রবা’ নামে একজন ভাই ছিলেন। এই দেবশ্রবার যখন পুত্র হয় তখন আকাশবাণী হয় “যদু বংশির হাতেই এর মৃত্যু হবে।” এই আকাশবাণী তে ভয় পেয়ে পুত্রের রক্ষা করার জন্য দেবশ্রবা তার পুত্রকে নদী তে ভাসিয়ে দেন। ভাসতে ভাসতে সেই শিশু মগধ রাজ্যের বনে পৌঁছালো। সেই বনের নিষাদ রাজ ‘হিরন্যধনু’ তাকে নিজের পুত্র রূপে পালন করেন এবং তার নাম রাখেন ‘একলব্য।’ এবার নিশ্চই বুঝতে পারছেন, যদু বংশের মতো মহান বংশের বংশোদ্ভূত হওয়ার কারনে একলব্য এত প্রতিভাবান এবং দুর্ধর্ষ ধনুর্ধর ছিলেন।


হরিশংকর জলদাস তার “একলব্য” বইতে বলেছেন, গুরু দ্রোণের কাছে নিগৃহীত একলব্য তার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ছাড়াই তার অনুশীলন চালিয়ে যান।  কালক্রমে মহাভারতের শেষভাগে যখন কুরু পান্ডব্দের মধ্যে মহারণের সূচনা হয়, তখন তিনি কৌরবপক্ষে যোগ দেন। কারন গুরু দ্রৌনাচার্য ও পান্ডুপুত্র অর্জুনের প্রতি তার মনে তীব্র ক্ষোভ দানা বেধেছিল, কেননা অর্জুনকে শ্রেষ্ঠ ধনুর্বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই তার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি গুরুদক্ষিণা হিসেবে চাওয়ার মত নিষ্ঠুরতম কাজ করেছেন গুরু দ্রোণ।


সেই সময়ে দ্রোণের থেকে প্রত্যাখ্যাত কর্নও তার প্রতি সমব্যথী ছিলেন। কারন তিনিও একলব্যের মত ক্ষত্রিয় না হবার জন্য অস্ত্র শিক্ষা পান নি। কর্নের প্রতি কৃতজ্ঞতা, দূর্যোধনের প্রতিশোধপরায়ণ প্ররোচনা আর অর্জুনের প্রতি ক্ষোভের জন্যই তিনি কৌরবপক্ষের হয়ে অস্ত্র ধারন করেন। যুদ্ধে কৌরবের পরাজয়ের পর তিনি আবার তার আবাসস্থল তথা জঙ্গলে ফেরত যান।


হরিবংশ পুরাণ আরও বলছে, বহুকাল পরে যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার মামা কংসকে বধ করেন, তখন কংসের শ্বশুর জরাসন্ধ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি চরমভাবে ক্রোধিত হন।  মগধের এই  সম্রাট কংস বধের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ১৭ বার মথুরা আক্রমণ করেন এবং প্রত্যেক বারই গুরুতর ভাবে পরাজিত হন। এই জরাসন্ধ যখন জানতে পারেন যে তার রাজ্যে একলব্যের মত একজন মহান ধনুর্ধর আছেন, তখন তিনি একলব্য কে তার সেনাপতি নিযুক্ত করেন। সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ায় পর একলব্য যুদ্ধক্ষেত্রে যাদব সেনাবাহিনীর একটি বড়ো অংশ ধ্বংস করে দেন। তার এই ভীষণ পরাক্রম দেখে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাকে বীরগতি প্রদান করেন। এইভাবে আকাশবাণী সত্য হয় এবং একলব্যের জীবনের সমাপ্তি ঘটে।


Post a Comment

Previous Post Next Post